ইট-কাঠের এই শহরে একচিলতে সবুজের দেখা পাওয়া যেন পরম শান্তির মতো, তাই না? ব্যস্ত জীবনে একটুখানি অবসর, আর সেই অবসরে নিজের হাতে ফলানো শাকসবজি বা ফলের স্বাদ – ভাবতেই ভালো লাগে! আজকাল বাংলাদেশে, বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোতে ছাদে ফল ও সবজি চাষ বা ছাদবাগান ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এর কারণও কিন্তু অনেক। একদিকে যেমন জায়গার অভাব, অন্যদিকে ফরমালিনমুক্ত টাটকা খাবারের আকাঙ্ক্ষা আর প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার ইচ্ছা। সত্যি বলতে, এই পদ্ধতিতে শহরে কৃষিকাজ এর এক নতুন দিগন্ত খুলে গেছে।
ভূমিকা: ছাদে ফল ও সবজি চাষ কেন এত জনপ্রিয় হচ্ছে বাংলাদেশে?
সত্যি বলতে, আমাদের শহরগুলোতে খালি জায়গা খুঁজে পাওয়াটাই এখন মুশকিল। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা আর খাঁটি খাবারের প্রতি টান কিন্তু দিন দিন বাড়ছে। বাজারে গেলেই মনে হয়, কোন সবজি বা ফলে কতখানি রাসায়নিক দেওয়া! এই ভাবনা থেকেই অনেকে ঝুঁকছেন ছাদে বা বারান্দায় নিজেদের প্রয়োজনীয় সবজি আর ফল ফলানোর দিকে। শুধু তাই নয়, ছাদে গাছ লাগানো যে মনের কতখানি খোরাক জোগায়, তা কেবল একজন বাগানীই বলতে পারবেন। এই ইট-পাথরের জঙ্গলে এক টুকরো সবুজ মানেই তো একরাশ সজীবতা! আর যাদের ছাদ নেই, তারাও কিন্তু ছোট পরিসরে বালকনিতে সবজি চাষ করে মনের শখ পূরণ করছেন।
উপকারিতা: ছাদবাগানের যে কত গুণ, জানলে অবাক হবেন!
ছাদবাগান করার উপকারিতা কিন্তু একটা-দুটো নয়, অনেক! আসুন, জেনে নিই সেগুলো:
পরিবেশের জন্য আশীর্বাদ:
শহরটা একটু ঠান্ডা রাখে: গাছপালা থাকলে চারপাশটা এমনিতেই একটু শীতল থাকে, তাই না? গাছেরা কার্বন ডাইঅক্সাইড টেনে নেয়, আর আমাদের জন্য অক্সিজেন দেয়।
বাতাসটাকেও পরিষ্কার করে: ধুলোবালি শোষণ করে আমাদের চারপাশের বাতাসকে অনেকটাই নির্মল রাখে।
ছোট্ট পাখিদের আশ্রয়: আপনার বাগানে দু-একটা টুনটুনি বা শালিক এলে মনটা ভরে যাবে!
শরীরের জন্য ভালো, মনের জন্যও:
একেবারে খাঁটি খাবার: নিজের হাতে ফলানো সবজি আর ফল! এর চেয়ে বিশুদ্ধ আর কী হতে পারে? ফরমালিনের কোনো ভয় নেই।
মনটা থাকে ফুরফুরে: গাছের যত্ন নেওয়া, নতুন পাতা বা ফুল দেখা – এসব কিন্তু দারুণ মানসিক শান্তি দেয়। চাপ কমাতে এর জুড়ি নেই।
হালকা ব্যায়ামও হয়ে যায়: বাগানে কাজ করলে অজান্তেই শরীরের একটু নাড়াচাড়া হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ভালো।
পকেটেরও সাশ্রয়:
বাজারের খরচ কমে: নিজের প্রয়োজনীয় সবজিটা যদি ঘর থেকেই পাওয়া যায়, তাহলে তো কথাই নেই! বাজারের খরচ কিছুটা হলেও কমে।
বাড়তি আয়ের সুযোগও হতে পারে: যদি একটু বড় করে বাগান করেন, তাহলে নিজের প্রয়োজন মিটিয়ে কিছু সবজি বা ফল বিক্রিও করতে পারেন।
পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি: ছাদবাগান শুরু করার আগে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখুন
যেকোনো কাজ শুরু করার আগে একটু পরিকল্পনা করে নিলে কাজটা সহজ হয়ে যায়। সফল ছাদবাগান তৈরির জন্যেও চাই ঠিকঠাক ছাদবাগান পরিকল্পনা আর কিছু প্রস্তুতি।
রোদ, রোদ আর রোদ (Sunlight):
বেশিরভাগ ফল আর সবজি গাছের জন্য দিনে অন্তত ৬-৮ ঘণ্টা ঝকঝকে রোদ কিন্তু চাই-ই চাই। তাই ছাদের এমন একটা কোণা বেছে নিন যেখানে দিনের বেশিরভাগ সময় রোদ থাকে।
একটু খেয়াল করে দেখুন, আপনার ছাদে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কোনদিকে কেমন রোদ লাগে।
পানি যেন জমে না থাকে (Water Drainage):
এটা কিন্তু খুব জরুরি একটা বিষয়! ছাদে পানি জমে থাকলে গাছেরও ক্ষতি, ছাদেরও ক্ষতি।
দেখবেন ছাদের ঢাল যেন ঠিক থাকে আর পানি বেরিয়ে যাওয়ার নালাটা যেন পরিষ্কার থাকে।
টব বা ড্রামের নিচে ফুটো তো থাকবেই, সাথে সাথে এগুলো সরাসরি ছাদের মেঝেতে না রেখে কিছু ইট বা স্ট্যান্ডের ওপর রাখলে ভালো হয়।
নিরাপত্তার দিকটাও ভাবুন (Safety Measures):
ছাদ কতটা ওজন নিতে পারবে, সে ব্যাপারে একটু ধারণা রাখা ভালো। খুব বেশি ওজনের টব বা সিমেন্টের বেড তৈরির আগে সম্ভব হলে একজন ইঞ্জিনিয়ারের সাথে কথা বলে নিতে পারেন।
ছাদের চারপাশে যদি রেলিং বা শক্ত বেড়া থাকে, তাহলে চিন্তা কম। বিশেষ করে বাড়িতে ছোট বাচ্চা থাকলে এটা খুব দরকারি।
ঝড়-বৃষ্টিতে টব বা গাছ যেন পড়ে না যায়, সেদিকেও নজর রাখতে হবে।
কোন ফল ও সবজি চাষ করবেন: যেগুলো আমাদের দেশে সহজেই হয়
ভাবছেন কী কী লাগাবেন? আমাদের দেশের আবহাওয়ায় ছাদে খুব সহজেই কিন্তু অনেক কিছুই ফলানো যায়। নতুন যারা শুরু করছেন, তাদের জন্য কিছু সহজ বিকল্প দিচ্ছি:
সবজি:
বেগুন, টমেটো (ছোট জাতগুলো ছাদে ভালো হয়), কাঁচালঙ্কা বা বোম্বাই মরিচ।
লাউ, চালকুমড়ো, মিষ্টি কুমড়া, শসা, ঝিঙে, চিচিঙ্গা (এগুলোর জন্য মাচা বা सहारा লাগবে)।
ঢেঁড়স, বরবটি (খুব সহজেই হয়)।
পালং শাক, লাল শাক, পুঁই শাক, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা (এগুলো অল্প জায়গায় অনেক হয়)।
লেটুস, ক্যাপসিকামও (একটু যত্ন নিলে) ভালো হয়।
ফল:
পেয়ারা (থাই পেয়ারা, কাজী পেয়ারা দারুণ ফলন দেয়)।
লেবু (কাগজি, এলাচি, সিডলেস – একটা লেবু গাছ থাকলে সারা বছর চিন্তা নেই)।
আম (আম্রপালি, বারি আম-৪ এর মতো ছোট বা কলমের চারা বেছে নিন)।
পেঁপে (ছোট জাতের পেঁপে ছাদে খুব ভালো হয়)।
ড্রাগন ফল (এখন বেশ জনপ্রিয়, তবে এর জন্য মাচা দরকার)।
আনার, মাল্টা, কমলা (এগুলোও কলমের চারা লাগাতে পারেন)।
পাত্র, মাটি ও সার: আপনার বাগানের শক্ত ভিত্তি
সঠিক পাত্র, উর্বর মাটি আর পরিমাণ মতো সার – এগুলোই কিন্তু আপনার ছাদে গাছ লাগানো এবং ভালো ফলনের মূল চাবিকাঠি।
কেমন পাত্র নেবেন (Containers):
মাটির টব তো আছেই (ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের)।
প্লাস্টিকের পুরনো বালতি বা হাফ ড্রাম (নিচে ফুটো করে নিতে ভুলবেন না)।
এখন গ্রো ব্যাগ পাওয়া যায়, হালকা আর ব্যবহার করাও সোজা।
যদি স্থায়ীভাবে কিছু করতে চান, তাহলে সিমেন্টের বেড তৈরি করে নিতে পারেন।
পুরোনো টায়ার বা কাঠের অব্যবহৃত বাক্সও কিন্তু দারুণ কাজে দেয়!
মাটি কেমন হবে (Soil Mix):
ছাদবাগানের জন্য মাটিটা ঝুরঝুরে আর হালকা হলেই ভালো, যাতে পানি জমে না থাকে আবার গাছের শিকড়ও সহজে বাড়তে পারে।
মোটামুটি একটা আন্দাজ দিই: সাধারণ মাটি বা দোআঁশ মাটি ৫০%, গোবর সার বা কম্পোস্ট ৩০%, আর কোকোপিট বা ধানের তুষ/কাঠের গুঁড়ো ২০% মিশিয়ে নিলে দারুণ মাটি তৈরি হয়।
মাটিটা রোদে শুকিয়ে বা অল্প ছত্রাকনাশক দিয়ে শোধন করে নিলে পোকা বা রোগের ভয় কম থাকে।
খাবার মানে সার (Fertilizer):
চেষ্টা করুন রাসায়নিক সারের বদলে জৈব সার ব্যবহার করতে। এতে আপনার সবজি হবে পুরোপুরি নিরাপদ আর স্বাস্থ্যকর।
বাসায় কিচেনের সবজির খোসা পচিয়ে কম্পোস্ট বানাতে পারেন, কেঁচো সার (ভার্মিকম্পোস্ট) তো দারুণ জিনিস! এছাড়া সরিষার খৈল, হাড়ের গুঁড়ো, ডিমের খোসা গুঁড়ো – এসবও খুব উপকারী।
মাঝে মাঝে সরিষার খৈল কয়েকদিন ভিজিয়ে রেখে সেই পানিটা ছেঁকে গাছের গোড়ায় দিন, দেখবেন গাছ কেমন তরতাজা হয়ে ওঠে!
পানি ও যত্ন: গাছের ভালো-মন্দ আপনার হাতেই
গাছ তো লাগালেন, এবার নিয়মিত যত্ন নিতে হবে। তবেই না সে আপনাকে মন ভরে ফল-ফুল দেবে!
পানি দেওয়ার নিয়মকানুন:
কখন পানি দেবেন? সহজ উপায় হলো, টবের উপরের মাটি একটু শুকিয়ে গেলেই পানি দিন। আঙুল দিয়ে একটু চেপে দেখলেই বুঝবেন।
সকালবেলা বা বিকেলের দিকে গাছে পানি দেওয়া সবচেয়ে ভালো। ভরদুপুরে কড়া রোদে পানি না দেওয়াই উত্তম।
বেশি পানি দেওয়াও কিন্তু গাছের জন্য ভালো নয়। খেয়াল রাখবেন গাছের গোড়ায় যেন পানি জমে না থাকে।
পোকা লাগলে কী করবেন (প্রাকৃতিক কীটনাশক):
রাসায়নিক কীটনাশক একদম ব্যবহার না করাই ভালো। পোকা লাগলে ঘাবড়াবেন না। নিম তেল (নিমের পাতা সেদ্ধ করেও ব্যবহার করা যায়), সাবান গোলা পানি, বা রসুন-মরিচ ছেঁচে পানিতে মিশিয়ে স্প্রে করে দেখুন, দারুণ কাজ দেয়।
ছত্রাক যাতে না লাগে, সেজন্য মাঝে মাঝে বোর্দো মিশ্রণ (তুঁতে আর চুন মিশিয়ে) স্প্রে করতে পারেন।
আরও কিছু টুকিটাকি যত্ন:
আগাছা জন্মালে তুলে ফেলে দিন, ওগুলো গাছের খাবার কেড়ে নেয়।
গাছের ডালপালা বেশি বেড়ে গেলে বা মরা ডাল থাকলে সেগুলো ছেঁটে (প্রুনিং) দিন।
ফল বা লতানো সবজির জন্য सहारा বা মাচা তৈরি করে দিন।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান: কিছু সমস্যা তো আসবেই, তবে সমাধানও আছে
ছাদবাগান করতে গেলে কিছু ছোটখাটো সমস্যা তো আসতেই পারে। তবে ভয়ের কিছু নেই, সহজ সমাধানও আছে।
প্রচণ্ড গরম: গরমকালে ছাদ বেশ তেতে ওঠে, তাই না? সেক্ষেত্রে ছায়াদানের জন্য শেড নেট ব্যবহার করতে পারেন। গাছের গোড়ায় খড়, শুকনো পাতা বা কচুরিপানা দিয়ে মালচিং করে দিলে মাটি ঠান্ডা থাকে। আর গরমকালে দিনে দুবার হালকা করে পানি দিতে হতে পারে।
বৃষ্টি যখন বেশি: বর্ষাকালে আবার বেশি বৃষ্টিতে গাছের গোড়া পচে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই টবে আর ছাদে পানি বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা যেন সবসময় খোলা থাকে, সেটা নিশ্চিত করুন।
পোকা আর রোগবালাই: নিয়মিত আপনার গাছগুলোকে একটু চোখে চোখে রাখুন। কোনো রকম পোকা বা রোগের লক্ষণ দেখলেই সাথে সাথে ব্যবস্থা নিন। ফেরোমন ফাঁদ ব্যবহার করেও অনেক পোকা দমন করা যায়।
পাখি বা কাঠবিড়ালির উৎপাত: ফল পাকার সময় হলে পাখি বা কাঠবিড়ালি এসে হানা দিতে পারে। ফলগুলোকে নেট দিয়ে ঢেকে দিতে পারেন অথবা পুরনো সিডি ঝুলিয়ে রাখলে অনেক সময় কাজ হয়।
উপসংহার: আপনার সবুজ স্বপ্নটাকে এবার সত্যি করুন!
শহুরে জীবনে ছাদে সবজি চাষ বা ফলের বাগান করাটা এখন আর শুধু শখ নয়, এটা একটা দারুণ জীবনশৈলী। প্রথম প্রথম হয়তো দু-একটা গাছ মরে যেতে পারে বা ফলন আশানুরূপ নাও হতে পারে, কিন্তু ধৈর্য হারাবেন না। চেষ্টা করতে থাকলে আর গাছের ভাষা বুঝতে শিখলে আপনিও আপনার ছাদে গড়ে তুলতে পারবেন এক টুকরো সবুজ স্বর্গ। বিশ্বাস করুন, নিজের হাতে ফলানো একটা টমেটো বা কাঁচালঙ্কার স্বাদ বাজারের কেনা জিনিসের চেয়ে অনেক অনেক গুণ বেশি। এই ছোট্ট চেষ্টাতেই আপনি পাবেন ফরমালিনমুক্ত টাটকা খাবার, মানসিক প্রশান্তি আর আপনার চারপাশের পরিবেশটাও হয়ে উঠবে আরও সুন্দর।
তাহলে আর দেরি কেন? আজই শুরু করে দিন আপনার স্বপ্নের ছাদবাগান পরিকল্পনা। অল্প করে শুরু করুন, দেখবেন সবুজের এই নেশা আপনাকে মুগ্ধ করে ফেলবে! আর হ্যাঁ, আপনার বাগানের অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে শেয়ার করতে ভুলবেন না যেন!